সাকার মাছের জন্ম, অবস্থান দক্ষিণ আফ্রিকায়। ভয়ংকর এ মাছ আশির দশকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। অ্যাকুরিয়ামে লালনপালনের জন্য মূলত এ মাছ নিয়ে আসা হয়। পরে অ্যাকুরিয়াম ছাড়িয়ে দেশের প্রায় সব মুক্তজলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ে এ মাছ। শখের সাকার মাছ এখন সব জলাশয়ে বিষ ছড়াচ্ছে। মাছচাষিদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাবনায় ফেলছে মাৎস্য বিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্টদেরও। যে হারে এর বৃদ্ধি হচ্ছে, তাতে পুরো মৎস্য খাতে এর কালো ছায়া পড়বে। নিষিদ্ধ এ মাছ সব ধরনের মাছের খাদ্য, রেণু, ডিম খায়। এছাড়া জলাশয়ের নিচে থাকা পচনশীল খাদ্য খাওয়াসহ এর শরীরে থাকা ভয়ানক কাঁটা দিয়ে অন্যসব মাছকে আঘাত করে। একেকটি মাছ ১০ থেকে ১২ বছর বাঁচে। ১৫ সেন্টিমিটার হলেই ডিম দিতে থাকে। ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হয়। লবণাক্ত কিংবা মারাত্মক দূষিত কালচে পানিতে-এরা বাঁচতে পারে। এদিকে করোনাকালে অ্যাকুরিয়ামে থাকা সাকার মাছ বিক্রি না হওয়ায় অধিকাংশ মাছ বিভিন্ন জলাশয়ে ফেলা হয়েছে।
দেশীয় মাছ কিংবা চাষের মাছ অথবা ফিরিয়ে আনা দেশীয় মাছ, কোনোটাই রক্ষা পায়নি ভয়ংকর সাকারের থাবা থেকে। এ মাছের শরীর অনুযায়ী মুখের সাইজ বেশ বড়। আফ্রিকান মাগুর, পিরানহা মাছের সঙ্গে বিভিন্ন বাজারে সাকার মাছও দেখা মিলছে। বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশেই এখন খাবার হিসেবে নিষিদ্ধ এ মাছটি পাওয়া যায়।
রাক্ষুসে স্বভাবের এ মাছ প্রজনন রোধ করতে কার্যকরি কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। অথচ, মাছ চাষিরা যুগের পর যুগ ধরে এ সাকার মাছের অপকারিতা, ক্ষতির বিষয়গুলো বিভিন্ন সভা, সমাবেশে তুলে ধরছেন। বাংলাদেশ সরকার রাক্ষুসে পিরানহা মাছের উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু, ভয়ংকর সাকার মাছ এখনো নিষিদ্ধ করা হয়নি।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, এটি নিঃসন্দেহে ভয়ানক মাছ। পৃথিবীর কোথাও এ মাছ খাওয়া হয় না। এ মাছ এখন সর্বত্র জলাশয়েই পাওয়া যাচ্ছে। পুকুর থেকে নদ-নদী, খাল-বিলে এ মাছ ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, কয়েক মাস আগে বুড়িগঙ্গা, মেঘনা, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন জলাশয় থেকে ৩৫টি সাকার মাছ গবেষণার জন্য সংগ্রহ করা হয়। গবেষণা ফলাফলে উঠে আসে এর নানা ক্ষতিকর দিকও। এটি ৭৬-৭৭ শতাংশ জলাশয়ের পচনশীল (ডেব্রিস) দ্রব্য খায়। সাধারণ মাছের যে খাবার মাটি ঘেঁষে থাকে তা নিমিশেই খেতে পারে। ১১ থেকে ৩৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সহজেই বেঁচে থাকতে পারে। শীত-গরম উভয় সময় এটি দাপিয়ে বেড়াতে পারে। লবণাক্ত পানিতেও চাঙ্গা থাকে এরা। একাধিক মৎস্য চাষি জানান, সাকার মাছ খাল-বিল, নদী-নালা পেরিয়ে পুকুরে পৌঁছেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ভয়ংকর এ মাছ হ্যাচারি থেকে শুরু করে গবেষণার কাজে ব্যবহৃত পুকুর জলাশয়েও ঝাঁকে ঝাঁকে পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় যে হারে এ মাছ ধরা পড়ছে তাতে বাংলাদেশের জন্যও আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। এ মাছ নিধনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রান্তিক মৎস্য চাষিরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলাম মোস্তফা সাংবাদিকদের বলেন, এটি এখন ভয়ানকরূপে পরিণত হয়েছে। আরও আগ থেকেই এ মাছ পুরোপুরি নিধনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। গবেষণায় এমন কিছু করতে হবে, যাতে এদের প্রজনন বৃদ্ধি না পায়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, শখের এ মাছ এখন আমাদের জন্য হুমকির। এ মাছ জলাশয়ে নিশ্চয় কেউ না কেউ ছেড়েছে। আমরা এ মাছ নিধনে, বংশবিস্তার রোধে প্রয়োজনীয় সব ধরনের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছি। এ মাছের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত ও ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে গবেষণা হয়েছে, আরও গবেষণা চলছে।
আপনার মতামত লিখুন :